গাজীপুরের কালীগঞ্জ চালাতেন ‘ছোট এমপি’ এপিএস সেলিম

মাজেদুল ইসলাম সেলিম

সাবেক মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির ব্যক্তিগত সহকারী (এপিএস) ছিলেন মাজেদুল ইসলাম সেলিম। তবে গাজীপুর জেলাজুড়ে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘এপিএস সেলিম’ নামে। কালীগঞ্জে কারো কারো কাছে তিনি ছিলেন ‘ছোট এমপি’।

 

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের কয়েক দিন আগে আমেরিকায় পালিয়ে যান সেলিম। বর্তমানে তিনি আমেরিকায় কেনা নিজ বাড়িতেই অবস্থান করছেন। এছাড়া দুবাই ও মালয়েশিয়ায় তাঁর ব্যবসা ও ফ্ল্যাট রয়েছে বলে জানান নেতাকর্মীরা। নেতাকর্মীরা বলেন, উপজেলার দেওপাড়া এলাকার বাসিন্দা সেলিম ছিলেন বেকার। ২০০৮ সালে মেহের আফরোজ চুমকি এমপি নির্বাচিত হলে সেলিমকে এপিএস হিসেবে নিয়োগ দেন। চুমকি এমপি হলেও তাঁর হয়ে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন সেলিম।

 

কে কোন দলীয় পদ পাবেন, ইউনিয়ন বা উপজেলা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী কে তা ঠিক করতেন তিনি। নিয়োগ ও বদলি, টেন্ডার, উন্নয়ন প্রকল্পের কাজও হতো তাঁর ইশারায়। সেভেন রিংস সিমেন্ট, প্রাণ-আরএফএল, আবুল খায়ের সিরামিকসহ উপজেলার সব কলকারখানার ঝুট ব্যবসায় তাঁর ছিল একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহরে শতকোটি টাকার বালু ভরাট, শীতলক্ষ্যা নদী থেকে বালু উত্তোলনেও ছিল তাঁর সিন্ডিকেট। তাঁর ভাই যুবলীগ নেতা কামরুল ইসলামের ছত্রচ্ছায়ায় চলত মাদক ব্যবসা ও পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি, যার ভাগ যেত সেলিমের কাছেও।

 

জানা গেছে, এপিএস হওয়ার কিছুদিন পর ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী লেনের ৬১ নম্বর বাড়ির ২ নম্বর ফ্ল্যাট কেনেন সেলিম। ২০২১ সালের ১১ মার্চ কালীগঞ্জ পৌরসভার মূলগাঁও শিল্প এলাকায় প্রাণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের পাশে ২৫৬২ নম্বর দলিলে ১৪৬.৩৮ (প্রায় সাড়ে চার বিঘা) শতাংশের একটি প্লট কেনেন তিনি। দলিলে দাম দেখান ৮০ লাখ টাকা। প্রকৃত দাম ছিল প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। রাজস্ব ফাঁকি দিতে কম দামে দলিল রেজিস্ট্রি করেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, এভাবে স্ত্রী, মা ও শাশুড়ির নামে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে কোটি কোটি টাকার প্লট ও জমি কিনেছেন।

 

সূত্র মতে, একই বছরের ১৬ আগস্ট তিনি ৫৩৭১ নম্বর দলিলে খলাপাড়া মৌজায় মা আনোয়ার বেগমের নামে এক বিঘার একটি প্লট কেনেন। দলিলে দাম ৩৫ লাখ টাকা লেখা হলেও ওই জমির দাম তখন ছিল কোটি টাকার বেশি। স্ত্রী রহিমা বেগমের নামে ১০৪৭৫/২০১৬ নম্বর দলিলে দেওপাড়া মৌজায় ৮০ লাখ টাকায় কেনেন ৮৭ শতাংশ (আড়াই বিঘা, প্রকৃত দাম দুই কোটি টাকা), ৫৫৬২/১৬ নম্বর দলিলে একই মৌজায় ছয় লাখ ২০ হাজার টাকায় (প্রকৃত দাম ৫০ লাখ টাকা) ৬.৫ শতক, ৮২০৪/১৭ নম্বর দলিলে ১৩ লাখ টাকায় (প্রকৃত দাম ৪৫ লাখ টাকা) মূলগাঁও মৌজায় ১৮.৫০ শতক, ৪৮২৪/১৩ নম্বর দলিলে পাঁচ লাখ ৬০ হাজার টাকায় দেওপাড়া মৌজায় ১০.৫ শতক, একই মৌজায় ৫৫২৯/১৫ নম্বর দলিলে তিন লাখ (প্রকৃত দাম ১৫ লাখ টাকা) টাকায় ৩ শতক, একই মৌজায় ৩৭৮৬/১৫ নম্বর দলিলে আট লাখ (প্রকৃত দাম ২৪ লাখ টাকা) টাকায় ৮ শতক, খলাপাড়া মৌজায় ৩৫৫৪/১৭ নম্বর দলিলে শাশুড়ি নূরজাহান বেগমের নামে ২৯ লাখ (প্রকৃত দাম ৬০ লাখ) টাকায় ৪৪ শতক এবং মূলগাঁও মৌজায় ৫৫৪৬/১৭ নম্বর দলিলে পাঁচ লাখ (প্রকৃত দাম ২০ লাখ) টাকায় ৮ শতক জমি কেনেন। এর বাইরে পূর্বাচলে নিজের ও স্ত্রীর নামে রয়েছে একাধিক প্লট। রয়েছে হ্যারিয়ারসহ একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি।

 

সেলিম বাইপাস সড়কের পাশে গোরাবাড়ী এলাকায় সাত বিঘা জমি কিনে আরএফএলের কাছে গোডাউন হিসেবে ভাড়া দিয়েছেন। ওই জমির দাম কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা। এছাড়া দেওপাড়ায় প্রাণ কারখানার সামনে সাড়ে চার বিঘা এবং আরএফএল কারখানার সামনে এক বিঘা জমিতে গোডাউন বানিয়ে প্রাণের কাছে ভাড়া দেন। সব গোডাউন থেকে মাসে ১০ লাখ টাকার বেশি ভাড়া পান তিনি।

 

আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল গনি বলেন, সেলিমের ভয়ে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের প্রথম সারির নেতারাও আতঙ্কে থাকতেন। তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খোলা মানেই নিশ্চিত দলীয় পদ হারানো। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান-মেম্বার কে হবেন তা তিনিই ঠিক করতেন। কেন্দ্র দখল করে পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করতেন। কালীগঞ্জ পৌরসভার গত নির্বাচনে তাঁর চাচা সাখাওয়াত হোসেন ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন। জনপ্রিয়তা না থাকলেও কেন্দ্র দখল করে চাচাকে বিজয়ী করার বিষয়টি ছিল বেশ আলোচিত।

 

কৃষক লীগ নেতা সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এমপির হয়ে নেপথ্যে কালীগঞ্জ চালাতেন এপিএস সেলিম। তাঁর বাড়ি উপজেলার শেষ সীমান্তে দেওপাড়া গ্রামে। নিয়ম অনুযায়ী উপজেলা মডেল মসজিদ নির্মাণ হওয়ার কথা উপজেলা শহরে। সেলিমের প্রভাবে মডেল মসজিদ করা হচ্ছে তাঁর বাড়ির পাশে রেলওয়ের জমি দখল করে। আরো কয়েকটি স্থাপনা সরকারি খরচে তিনি নিজের এলাকায় গড়ে তোলেন, যা মানুষের কাজে লাগেনি।

 

জানা গেছে, এপিএস সেলিম, স্ত্রী রহিমা বেগম, ভাই কামরুল ইসলাম, শহীদুল ইসলাম লিটন, মামুনুল ইসলাম, মা, শাশুড়িসহ পরিবারের সাতজনের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে গত ১৪ ডিসেম্বর দুদকের সহকারী পরিচালক মো. রুহুল হককে তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হয়। কিন্তু তারপর তদন্তের বিষয়টি আর আলোর মুখ দেখেনি। সম্পদ ও অভিযোগের বিষয়ে জানতে সেলিমের মোবাইল ফোনে কল দিয়ে বন্ধ পাওয়া যায়। তাঁদের ভাইদের মোবাইল ফোনও বন্ধ।

সেলিমের বাবা মোছলেম উদ্দিন ছিলেন জনতা জুট মিলের সামান্য শ্রমিক। ছিল অভাবের সংসার। চুমকির এপিএস হওয়ার পর ভাগ্য রাতারাতি বদলে যায় সেলিমের। তাঁর হাতের মুঠোয় চলে আসে প্রবল ক্ষমতা।

 

ভাইদের নিয়ে গড়ে তোলেন বিশাল সিন্ডিকেট। ঝুট ও বালু ব্যবসা, মাদক ব্যবসায় মদদ, জমি দখল, তদবির, বদলি ও নিয়োগ বাণিজ্য, পূর্বাচলে প্লট ও ঘুষ বাণিজ্যে জড়িয়ে দেশে-বিদেশে নামে-বেনামে গড়েন সম্পদের পাহাড়। তাঁর প্রভাব এতটাই ছিল যে গাজীপুরের কালীগঞ্জে গত ১৬ বছরে তাঁর কথাই ছিল শেষ কথা।